প্রথম অধ্যায় লেকচার-২১: সমাজ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) প্রভাব।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি

সমাজ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব বা সমাজে তথ্য প্রযুক্তির সুফল/অবদান:

তথ্য প্রযু্িক্ত মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব সুফল বয়ে এনেছে সেগুলো হলো-

  • অপচয় কমায়: তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার যেকোনো ধরনের অপচয় রোধ করে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ধরনের ব্যয়কে সংকুচিত করে আর্থিক সাশ্রয় ঘটিয়ে থাকে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসেই বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ফোন বিলের মতো বিভিন্ন ইউটিলিটি বিলগুলো এখন মোবাইল ফোনেও দেয়া যায়।
  • সময় বাঁচায়: তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো কাজে আগের চেয়ে কম সময় লাগে অর্থাৎ এর মাধ্যমে সময় সাশ্রয়ী ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।
  • দক্ষতা বৃদ্ধি: তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও চর্চার ফলে ক্রমান্বয়ে সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ব্যবস্থাপকরা দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং দক্ষতার সাথে পরিচালনা মাধ্যমে ব্যবসায়-বাণিজ্যে লাভজনক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেন।
  • তথ্যের প্রাচুর্য: তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে যেকোনো তথ্যের প্রাপ্যতা এখন সহজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বিশ্বটাকেই পাওয়া যাচ্ছে হাতের মুঠোয়। নেটে সার্চ দিয়ে প্রায়োজনীয় যে কোনো তথ্য মুহূর্তেই দেখা যায়।
  • দ্রুত যোগাযোগ: তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে এখন তাৎক্ষণিক যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। ফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, ই-মেইল, এসএমএস, এমএমএস প্রভৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
  • ভিডিও কনফারেন্সিং: কম্পিউটারনির্ভর তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূর-দূরান্তে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গ সময় এবং অর্থ খরচ কমিয়ে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে মতামত আদান-প্রদান করতে পারে।
  • ব্যবসায়-বাণিজ্যে: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ব্যবসায়Ñবাণিঝ্যে নতুন হাওয়া লেগেছে। প্রথাগত ব্যবসার বাইরে ই-কমার্স এর প্রচলন ঘটেছে। বিশ্বের এক প্রান্তের কোনো ক্রেতা তার ঘরে বসেই কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্যের অর্ডার দিতে ও তার অর্থ অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারছেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উক্ত পণ্য ক্রেতার ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। বিশাল পরিমাণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখন অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে।
  • মনুষ্যশক্তির অপচয় কমায়: শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার মনুষ্যশক্তির অপচয় কমায়। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবোট ব্যবহার করে নানা রকম বিপজ্জনক ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ যেমন- ওয়েল্ডিং, ঢালাই, ভারী মাল ওঠানো বা নামানো, যন্ত্রাংশ সংযোজন ইত্যাদি করা হয়।
  • শিক্ষাক্ষেত্রে: শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। অনলাইনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা, পরীক্ষা দেয় কিংবা শিক্ষামূলক বিভিন্ন ওয়েবসাইট হতে শিক্ষা লাভ করা যায়। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধা থাকলে বিশ্বেও যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থী তার শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
  • ই-গভর্নেন্স: তথ্য প্রযুক্তি নির্ভও ই-গভর্নেন্স চালুর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে কাজের সুসমন্বয় ঘটানো যায়। ই-গভর্নেস-এর বাস্তবায়ন সরকারি কর্মকান্ডকে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ করে দ্রæততার সাথে সিদ্ধান্ত প্রদান, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমায় এবং সরকারের সঙ্গে জনগণের স্বয়ংক্রিয় সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থায়: সড়কপথ, রেলপথ. জলপথ এবং আকাশপথের যোগাযোগর ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করেছে সহজতর, দ্রæত, নিরাপদ এবং আরামদায়ক।
  • চিকিৎসায়: বর্তমানে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসক এক দেশে বসে একই সময়ে অন্য দেশের রোগীদের সেবা প্রদান করতে পারেন। চিকিৎসাক্ষেত্রের জটিল সব অপারেশনে সার্জনদেও নানা ধরনের কাজে রোবট সহায়তা করে।
  • কর্মসংস্থান: কর্মসংস্থানের বিশাল বাজার উন্মুক্ত করেছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন বিশ্বেও যেকোনো দেশের যেকোনো কর্মী অন্য যেকোনো দেশের কর্মদাতার কাজ ঘরে বসেই করতে পারেন এবং তার কাজের পেমেন্ট অনলাইনেই গ্রহণ করতে পারেন।
  • বিনোদনক্ষেত্রে: ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ফেসবুক, মাইস্পেস, ইউটিউব, অরকুট ইত্যাদি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও ভিডিও অপলোডিং সাইটে বন্ধুত্ব তৈরি করার পাশাপাশি ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা যায়। আজকাল ইন্টারনেটে টিভি ও রেডিও চালু হওয়ায় স্ট্রিমিং অডিও-ভিডিও প্রযুক্তির মাধ্যমে দূর-দূরান্তে বসেও টিভি ছাড়াই কম্পিউটারে টিভি দেখা যায়।
  • প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়: বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে আজ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক সেনাবাহিনীর সব শক্তির মূলেই রয়েছে তথ্য প্রযুক্তি। সমরাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, সব ধরনের ব্যবস্থাপনা, চালকবিহীন ক্রুজ, টোমা হক, স্কার্ড প্রভৃতি ক্ষেপণাস্ত্র নির্ভুলভাবে শত্রুর এলাকায় নিক্ষেপ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি।

 

সমাজ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব বা সমাজে তথ্য প্রযুক্তির কুফল:

তথ্য প্রযুক্তির মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন সুফল বয়ে এনেছে, যেমনি সাথে করে নিয়ে এসেছে বেশ কিছু কুফল। যেমন-

  • অপরাধপ্রবণতা: স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এখন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন টেলিভিশনে চ্যানেল ঘরে বসেই দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে হানাহানি, মারামারির মতো সাংস্কৃতিক উপাদানও রয়েছে যা অন্য দেশের সমাজকেও প্রভাবিত করছে। ভায়োলেন্সপূর্ণ কম্পিউটার গেমস দেখে শিশুরা ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠতে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড কালিয়াতির মতো ঘটনাও প্রায় ঘটছে।
  • অশ্লীলতা: ইন্টারনেটে এমন কিছু অশ্লীল সাইট রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে মানুষের নৈতিক স্থলন ঘটতে পারে। এসব সাইটে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক অনুপযোগী বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও থাকে, যা নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটাতে পারে। এতে সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টির ঝুঁকি রয়েছে।
  • তথ্যের গোপনীয়তা প্রকাশ: তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে এখন প্রযুক্তিগত সুবিধা অতটাই বেড়েছে যে এর অপব্যবহার করে ব্যক্তির গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। হ্যাকারের আক্রমণে কম্পিউটারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি চুরি হয়ে যাওযা, মুছে যাওয়া, পাসওয়ার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চুরি হওয়ার মাধ্যমে তথ্যের গোপনীয়তা আর থাকছে না।
  • বেকারত্ব সৃষ্টি: তথ্য প্রযুক্তির উপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। আর তাই এসব ক্ষেত্রে কম মানবসম্পদের প্রয়োজন পড়ায় কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে অনেক সময়েই বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে।
  • শারীরিক সমস্যা: টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা কম্পিউটার ব্যবহারকারী সারাক্ষণ মনিটরের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন। একনাগাড়ে কম্পিউটারে কাজ করার মাধ্যমে কোমর, হাত, কব্জিতে ব্যথা, ভিডিও গেমের মাধ্যমে শিশুদের মানসিক আসক্তি, অধিক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে হৃদপিন্ড, কান ও মস্তিষ্কে নানা ধরনের অসুখ হতে পারে।
  • বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিগ্রস্ততা: তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে মৌলিক গবেষণা থেকে মানুষ দূরে থাকবে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রায় সব ধরনের সমস্যার সমাধান সহজে পাওয়ার কারণে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার হতে দূরে থাকবে। ফলে আমাদের সমাজ ও জাতি মেধাবী প্রজন্ম হতে বঞ্চিত হবে।
  • মিথ্যা প্রচারণা: তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই মিথ্যা প্রচারণা করা যায়। ফেসবুক, ওয়েবসাইট, ব্লগ সাইটে কারো ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, সংবাদ এডিট করে মিথ্যা ছবি বা তথ্য প্রকাশ কর সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন বা মানহানি করা যায়। এসব কাজের মাধ্যমে ভয়াবহ দাঙ্গা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও দেশের সার্বভৌমত্বের হুমকি, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়।
  • ডিজিটাল ডিভাইড: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী এবং এসব সুযোগ হতে বঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাভোগকারী লোকদের মধ্যকার ব্যবধানই হলো ডিজিটাল ডিভাইড। উন্নত দেশগুলো সর্বাধুনিক সব ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে সেসব সুবিধা পায় না কিংবা তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলো পুরনো। এর ফলে বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর দু’প্রান্তে বসবাসকারী লোকজনের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।

 

প্রথম অধ্যায় লেকচার-২০: আইসিটি ব্যবহারের নৈতিকতা (Ethics of using ICT) ও কম্পিউটার ক্রাইম।



Written by:

Habibur Rahman(Habib Sir)
Author at www.habibictcare.com
Email:habibbzm2018@gmail.com
Cell: +8801712-128532,+8801913865284

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *