রোবট(Robot) বিজ্ঞান বা রোবটিক্স
রোবট (Robot) শব্দটির উৎপত্তি ‘Robota’ বা ‘Roboti’ স্লাভিক শব্দ থেকে। ‘Roboti’ শব্দের অর্থ দাস(Slave) বা কর্মী(Worker)। রোবট(Robot) হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা যন্ত্র মানব যা মানুষের অনেক দুঃসাদ্য ও কঠিন কাজ করতে পারে। আর প্রযুক্তির যে শাখায় রোবটের নকশা বা ডিজাইন,গঠন,পরিচালন প্রক্রিয়া, কাজ ও প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেই শাখাকে রোবটিক্স (Robotics) বলে।
১৯২০ সালে চেক নাট্যকার কারেল ক্যাপেক(Karel Cepek) তার নাটকে প্রথম রোবট(Robot) কথাটি ব্যবহার করেন এবং ১৯৪১ সালে জনপ্রিয় আমেরিকান লেখক এবং বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক আইজ্যাক অ্যাশিমো ছোটগল্প লিরা (Lira) তে সর্বপ্রথম রোবটিক্স (Robotics) শব্দটি ব্যবহার করেন।
সর্বপ্রথম ডিজিটাল ও প্রোগ্রামেবল রোবট (Robot) আবিষ্কার করেন জর্জ ডেবল। এ জন্য জর্জ ডেবলকে রোবটিক্সের জনক বলা হয়।
রোবটের(Robot) প্রকারভেদ :
রোবট (Robot) সাধারনত ২ ধরনের-
১.অটোনোমাস বা স্বয়ংক্রিয় রোবট(Robot): ঘরবাড়ি বা আবর্জনা পরিষ্কারসহ বাড়িঘরের কাজ বা মহাশূন্যের কাজে ব্যবহৃত রোবট হলো অটোনোমাস বা স্বয়ংক্রিয় রোবট।
২.সেমি অটোনোমাস বা আধা-স্বয়ংক্রিয় রোবট(Robot): যে সমস্ত রোবটকে পরিচালনার জন্য মানুষের কিছু নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা প্রয়োজন হয়, সেগুলো সেমি অটোনোমাস বা আধা-স্বয়ংক্রিয় রোবট।
সোফিয়া রোবট (Robot) কে বিশ্বের প্রথম সামাজিক রোবট বলা হয়, যা তৈরি করে হংকং ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান যার নাম হ্যানসন ।
রোবট(Robot) তৈরিতে যে সকল বৈশিষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়-
১.দৃষ্টিশক্তি বা ভিজুয়্যাল পারসেপশন(Visual Perception)
২.সংস্পর্শ বা স্পর্শ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সক্ষমতা(Tactile Capabilities)
৩.নিয়ন্ত্রন ও ম্যানিপুলেশনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বা নিপুনতা(Dexterity)
৪.যে কোন স্থানে দৈহিকভাবে নড়াচড়ার ক্ষমতা বা লোকোমোশন(Locomotion)
৫.কোন গন্তব্যে যাবার পথকে যথাযথভাবে খুঁজে বের করার বুদ্ধিমত্তা বা নেভিগেশন(Navigation)
রোবোটের(Robot) বিভিন্ন উপাদান বা অংশ
মুভেবল বডি (Movable Body): স্থানান্তরিত হবার জন্য একটি রোবোটে চাকা, যান্ত্রিক সংযোগসম্পন্ন পা কিংবা অন্য কোনো ধরনের নড়াচড়া করাতে সক্ষম যন্ত্রপাতি।
অ্যাকচুয়েট (Actuator): একচুয়েটর হলো এক ধরনের মোটর যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোবটের হাত-পা নড়াচড়া করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।। এককথায় এটিকে মানুষের মতো রোবোটের হাত-পায়ের পেশি হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
বৈদ্যুতিক উৎস বা পাওয়ার সিস্টেম (Power system):
অ্যাকচুয়েটরকে কার্যকর করতে হলে রোবোটের প্রয়োজন বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং এর জন্য ইলেকট্রিক রোবোটসমূহ সাধারণত লেড এসিড ব্যাটারি বা এক্সটেনসন কর্ড ব্যবহার করে। এ ধরনের ব্যাটারি রিচার্জেবল হয়ে থাকে এবং রোবোটকে(Robot) কাজ করার পর বা কাজ করার পূর্বে ব্যাটারি রিচার্জ করা প্রয়োজন হয়। তবে হাইড্রেলিক রোবোটের ক্ষেত্রে রিচার্জের পরিবর্তে এর হাইড্রোলিক ফ্লুয়িডকে প্রেসারাইজ করার জন্য পাম্প এর প্রয়োজন হয় এবং নিউম্যাটিক রোবোটের রিচার্জের জন্য এয়ার কমপ্রেশার প্রয়োজন হয়।
ইলেকট্রিক সার্কিট (Electric circuit): বৈদ্যুতিক রোবোটের মোটরসমূহে বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদান করতে ইলেকট্রিক সার্কিট ব্যবহার করা হয়। একই সাথে হাইড্রোলিক ও নিউমেটিক সিস্টেমের রোবোটকে নিয়ন্ত্রণকারী সলেনয়েড বা ভালসমূহকেও ইলেকট্রিক সার্কিটটের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদান করে।
মস্তিষ্ক বা কম্পিউটার (Brain Or Computer): রোবোটের মধ্যে স্থাপিত প্রোগ্রামকৃত মস্তিষ্ক বা কম্পিউটার একটি রোবটের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কোনো কারণে রোবোটের (Robot) আচরণ পরিবর্তন প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে এর ভেতরে থাকা কম্পিউটার রিপ্রোগ্রাম করা হয়।
অনুভূতি (Sensing):
অনুভূতি রোবোটের (Robot) একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মানুষের যেমন যে কোনো উদ্দীপনায় সাড়া দেয়ার অনুভূতি থাকে তেমন অনুভূতি রোবোটের মধ্যেও তৈরি করা যায়, বিভিন্ন উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম। যেমন, রোবোটের হাত বা পা যে কোনো জায়গা স্পর্শ করলে সে জায়গা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নেয়ার ক্ষমতা রোবোটের থাকতে পারে। মানুষের চোখের ন্যায় রোবোটে স্থাপিত ক্যামেরা দিয়ে সামনে বা পেছনের দৃশ্য গ্রহণ করা সম্ভব। যার ফলে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে রোবোটকে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘোরানো যেতে পারে।
ম্যানিপুলেশন বা পরিবর্তন করা (Manipulation):
রোবট তার আশেপাশের বস্তুগুলোর অবস্থান পরিবর্তন বা বস্তুকে ধরতে বা উঠাতে সক্ষম হয় তার হাত-পা এর মাধ্যমে, রোবটের হাত-পা এর সাহায্যে তার আশেপাশের বস্তুগুলোর অবস্থান পরিবর্তন বা বস্তুটি পরিবর্তন করার পদ্ধতিকে ম্যানিপুলেশন বলে। একই সাথে রোবোট (Robot) তার পায়ের সাহায্যে সামনে বা পেছনে, ডানে বা বামে চলাচল করতে পারবে।
রোবোটিক্স বা রোবটের ব্যবহার
১. ম্যানুফ্যাকচারিং-এ: কম্পিউটার এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং (ক্যাম)-এ রোবোটিক্স ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে যানবাহন ও গাড়ির কারখানায় রোবোট ব্যবহৃত হয়।
২. বিপজ্জনক কাজে: যে সকল কাজ স্বাভাবিকভাবে মানুষের জন্য বিপজ্জনক যেমন- বিস্ফোরক নিষ্ক্রীয়করণ, ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুসন্ধান, খনির অভ্যন্তরের কাজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে রোবোটিক ডিভাইস বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় হয়ে থাকে।
৩. ভারী শিল্প কারখানায়: কারখানায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবোটের সাহায্যে নানা রকম বিপজ্জনক ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ যেমন- ওয়েল্ডিং, ঢালাই, ভারী মাল ওঠানো বা নামানো, যন্ত্রাংশ সংযোজন ইত্যাদি করা হয়।
৪. পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষার কাজে: রোবোট (Robot) অতিক্ষুদ্র মাইক্রোসার্কিটের উপাদান পুনঙ্খানুপুরঙ্খরূপে অবিশ্বাস্যভাবে পরীক্ষা করতে পারে, যা করা মানুষের পক্ষে কঠিন এবং অসম্ভব।
৫. মেইল ডেলিভারির কাজে: বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে বিল্ডিংসমূহ জুড়ে বিভিন্ন মেইল স্টেশনে মেইল ডেলিভারির কাজে বিশেষ ধরনের রোবোট (Robot) ব্যবহার করা হয়। আল্ট্রা ভায়োলেট পেইন্ট দিয়ে মার্ক করা রুটগুলোকে এসব রোবোট অনুসরণ করে।
৬. ঝুঁকিপূর্ণ কাজে: পারমাণবিক কেন্দ্রে ক্ষতিকর তেজষ্ক্রিয়ায় যেসব কর্মী কাজ করেন তাদের ঝুঁকি অনেক। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মানুষের বদলে রোবোট (Robot) কাজ করতে পারে।
৭. নিরাপত্তার কাজে: উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার জন্য রোবোট (Robot) ব্যবহৃত হয়। মাইক্রোওয়েভ ভিশনের মাধ্যমে যেকোনো অধাতব দেয়ালের অপর পাশে কি আছে তা দেখতে পারে, অন্ধকারে কয়েকশ ফুট দূর থেকেও আগন্তুককে দেখতে পায় নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা রোবোট। তাই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভবন পাহারায় ব্যবহার করা হয়।
৮. পুলিশের সাহায্যকারী হিসেবে: বিশ্বের বহু দেশে পুলিশ বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় রোবোটকে ব্যবহার করে। যেমন-জিম্মি মুক্ত করা, গোলাগুলি ইত্যাদিও মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় রোবোটকে ব্যবহার করে। যেমন- জিম্মি মুক্ত করা, গোলাগুলি ইত্যাদির মতো পরিস্থিতিতে গুলি করতে, দরজা খুলতে, সামনে গিয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করতে বা ক্যামেরার সাহায্যে জানালায় নজর রাখতে ঘটনাস্থলে রোবোটকে ব্যবহার করা হয়।
৯. সামরিক ক্ষেত্রে: সামরিক ক্ষেত্রেও রোবোটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বোমা নিষ্ক্রিয় করা, ভূমি মাইন শনাক্ত করা, সামরিক নানা সরঞ্জমাদি বহন এবং অন্যান্য মিলিটারি অপারেশনে রোবোট ব্যবহার করা হয়।
১০. ঘরোয়া কাজে: কিছু কিছুরোবোট হাঁটতে পারে এবং মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। প্রাত্যহিক অনেক কাজকর্ম; যেমন- কফি তৈরি করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজে রোবোটকে ভৃত্যের মতো ব্যবহার করা যায়।
১১. চিকিৎসায়: চিকিৎসাক্ষেত্রে জটিল সব অপারেশনে সার্জনদের নানা ধরনের কাজে রোবোট (Robot) সহায়তা করে।
১২. মহাকাশ গবেষণায়: মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে রোবোটের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মানুষের পরিবর্তে মহাকাশ অভিযান এখন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সংবলিত রোবোট ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি মঙ্গলগ্রহে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা কর্তৃক ‘কিউরিসিটি’ নামের একটি রোবোট (Robot) পাঠানো হয়েছে যেটি মঙ্গলের পরিবেশ, প্রকৃতি ইত্যাদি হতে তথ্য নিয়ে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে।
রোবোটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা সুবিধাসমূহ
১. রোবোট নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিধায় যে কোনো কাজ দ্রুত ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম।
২. রোবোট বিরতিহীন ও ক্লান্তিহীনভাবে দিনরাত একটানা কাজ করতে পারে।
৩. রোবোট যে কোনো মানবিক অনুভূতি তথা রাগ, ঘৃণা, ভয়, বিরক্তি প্রভৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বিধায় তার কাজে মানবিক অনুভূতির কোনো বাঁধা সৃষ্টি হয় না।
৪. রোবোট পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনুভব করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রদত্ত সক্ষমতা অনুসারে তার কাজের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
৫. যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর অসহনীয় পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে।
৬.রোবট দ্বারা তৈরি পন্যের গুনগতমান খুব ভালো ও সূক্ষ্ণতাও বেশি।
৭. রোবটের কাজ করার গতি বেশি তাই আউটপুট বেশি পাওয়া যায়।
৮. বিপজ্জনক পরিবেশে রোবটের মাধ্যমে কাজ করা নিরাপদ।
রোবোট ব্যবহারের অসুবিধাসমূহ
১.রোবট সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত তাই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না।
২.মানবকর্মীর মতো রোবোট কোনো আকস্মিক পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে পারে না যদি না তার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়।
৩.রোবোট ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, মানুষও ধীরে ধীরে তার কর্ম দক্ষতা হারিয়ে ফেলছে।
৪.রোবোট ব্যবহার এখনও অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর ব্যবস্থাপনা এখনও সহজসাধ্য হয়নি।
৫.রোবট পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হয়।
৬.ভূল সংশোধন বা ভূল থেকে শিক্ষা নিতে পারে না।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন
Written by,
Habibur Rahman(Habib Sir)Author at www.habibictcare.com
Email:habibbzm2018@gmail.com
Cell: +8801719686168, +8801913865284